বিবরণমূলক লেখার বৈশিষ্ট্য

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বাংলা - Bangla - লেখা পড়ি লেখা বুঝি | NCTB BOOK

যেসব বৈশিষ্ট্য থাকলে কোনো লেখাকে বিবরণমূলক লেখা বলা যায়, সেসব বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে তিনটি বৈশিষ্ট্য নিচে লেখো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                           

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                           

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                           

 

হায়াৎ মামুদ (১৯৩৯) একজন খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। শিশু-কিশোরদের জন্যও তিনি লিখেছেন। 'প্রতিভার খেলা', 'নজরুল', 'রবীন্দ্রনাথ', 'বাংলা লেখার নিয়ম কানুন' ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বইয়ের নাম। নিচের বিবরণমূলক রচনাটি লেখকের 'রবীন্দ্রনাথ: কিশোর জীবনী' বই থেকে নেওয়া হয়েছে।

 

 

রবীন্দ্রনাথ

হায়াৎ মামুদ

 

 

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মেছিলেন উনিশ শতকের শেষ দিকে। সেদিন ছিল বাংলা ১২৬৮ সালের ২৫শে বৈশাখ, ৭ই মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ। নিজেই তিনি বলেছেন, 'আমি জন্ম নিয়েছিলুম সেকেলে কলকাতায়।' তখন ট্রাম ছিল না, বাস ছিল না, মোটরগাড়িও ছিল না। ছ্যাকড়া গাড়ি ছিল। ঘোড়ায় টানত, আর ধুলো উড়ত রাস্তায়। কলকাতা শহরের বুকে তখন পাথরের চাঙ্গড় বসেনি, পথঘাট তখনও অনেক কাঁচা ছিল। বড়ো বড়ো দালানকোঠার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যেত একটা দুটো পুকুর, তার জলে সূর্যের আলো পড়ত ঝিকমিক; বিকেলে অশ্বত্থের ছায়া দীর্ঘতর করে পশ্চিমে পাটে বসত সূর্য: হাওয়ায় দুলত নারকেল গাছের সরু সরু পাতা, পাতার শব্দ হতো ঝিরঝির। মাঝে মাাঝে কোনো গলি থেকে অকস্মাৎ আওয়াজ উঠত পালকি বেহারাদের হাঁই-হুই, কখনো কখনো বা বড়ো রাস্তা থেকে সহিসের হেঁইও হাঁক।

সাবেক কালের পুরনো বিরাট প্রাসাদ, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের। লোকে বলত, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের ৫ নম্বর আর ৬ নম্বর মোট দুটো বাড়ি মিলিয়ে এই পারিবারের বাসস্থান। ৫ নম্বর বাড়িটি ছিল বৈঠকখানা। এ জায়গায় বাড়ির পত্তন কিন্তু প্রিন্স দ্বারকানাথের আমলে হয়নি, হয়েছিল তাঁর পিতামহ নীলমণি ঠাকুরের আমলে রবীন্দ্রনাথের জন্মেরও প্রায় পঁচাত্তর বছর পূর্বে। সেটাই হলো গোড়াপত্তন। তারপর ক্রমে ক্রমে পুরনো বসতবাড়ি প্রয়োজনের তাগিদে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে নানা মহল। ঘর অসংখ্য। বহু তলায় বা বহু ছাদে ওঠানামার জন্যে নানা রকম সিঁড়ি এখানে-ওখানে। যেন এক গোলকধাঁধা সারাটা বাড়ি।

প্রিন্সের ঐশ্বর্য তখন আর কিছুই নেই তাঁর পুত্রের আমলে; ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তো প্রিন্স নন, ঋষি। কিন্তু তখন সেই বিরাট প্রাসাদের বড়ো বড়ো দেউড়িতে প্রাচীনকালের স্মৃতি-ভাঙা ঢাল, বর্শা, মরচে-পড়া তলোয়ার ঝুলছে। উঠোনই তো তিন-চারটে; বাগান বড়ো বড়ো সদর-অন্দরের আলাদা আলাদা। বাড়িভরা লোক, আগুনতি দাসদাসী, সব সময়ে হৈ হৈ গমগম করছে। তখন গ্যাসবাতি ছিল না, বিজলি বাতি আসেনি, কেরোসিনের তেলের আলোও তখন জানত না কেউ। সন্ধেবেলায় ঘরে ঘরে ফরাস এসে রেড়ির তেলের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যেত। তখন পানির কল বসেনি-আজকাল শহরে যেমন ট্যাপ-ওয়াটার, তেমন সেদিন ছিল না: টিউবওয়েলও লোকে জানত না তখন। দুজন বেহারা বাঁকে করে কলসি ভরে মাঘ-ফাগুনের গঙ্গা থেকে পানি তুলে আনত। একতলার অন্ধকার ঘরে সারি সারি ভরা থাকত বড়ো বড়ো জালায় সারা বছরের খাবার জল। দেউড়িতে ঘণ্টা বাজত ঢং ঢং ঢং।

সে এক অন্য যুগ। ঐ রকম আলো-আঁধার-ঘেরা বিরাট প্রাসাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন, বড়ো হচ্ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য কী জানো? প্রিন্স দ্বারকানাথের পৌত্র হয়েও রাজার হালে মানুষ হননি তিনি। শৈশবে ও বাল্যে যেভাবে তাঁর দিন কেটেছে, তার তুলনায় এখন রাজপুত্রের মতো আছ তোমরা।

বহু পরে দুঃখ করে লিখেছিলেন, 'আমি ছিলুম সংসার-পদ্মার বালুচরের দিকে, অনাদরের কূলে।' আসলেই তো তাই। ছেলেবেলায় বাবা-মা ভাই-বোনদের স্নেহ, আদর-যত্নই আমাদের একমাত্র সম্বল, সবচেয়ে কাম্য; অথচ এই বালক তার কিছুই পাননি। রুগ্ন মা ছেলের কোনো খোঁজ-খবরই রাখতে পারেন না। আর বাবা সর্বদাই বাইরে ঘুরে বেড়ান স্থান থেকে স্থানান্তরে, বাড়িতে আসেন যেন দুদিনের মুসাফির। বয়োজ্যেষ্ঠ ভাই-বোনেরাও যে যার খেয়ালে, অথচ চোদ্দ জন ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই তো কনিষ্ঠ। তাহলে কে আছে এই শিশুর? আছে বাড়ির পুরাতন দাসদাসী। আছে তিনকড়ি দাই, কিংবা শঙ্করী, কিংবা প্যারী। তাদের পায়ে পায়ে ঘুরে, স্নেহ- তিরস্কারে দিন চলে যায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, ফিকে জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়ে বিরাট টানা বারান্দায়। সেই স্বল্লালোকে বারান্দায় পা মেলে দিয়ে বসে উরুর উপর প্রদীপের সলতে পাকাচ্ছে তারা আর নিজেদের মধ্যে গুনগুন করে যে যার দেশের কথা বলাবলি করছে। তাদেরই পাশে এক কোণে চুপচাপ সুবোধ ছেলে রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন হয়তো। রাত্রে মশারির ভিতরে শুয়ে ঘুম আসে না। তিনকড়ি দাসী গল্প বলে, রূপকথা: 'তেপান্তরের মাঠ-জোচ্ছনায় যেন ফুল ফুটে রয়েছে।' প্রকান্ড মাঠ ধূ ধূ, এপার-ওপার দেখা যায় না, ধবধবে রুপোলি চাঁদনি, রাজপুত্রের ঘোড়া ছুটছে-খটাখট খটখট খটাখট।

 

কিন্তু এই রূপকথা শোনার সুখও ভাগ্যে সইল না শেষাবধি। বয়স একটু বাড়তেই, পাঁচ-ছ বৎসরের বালককে অন্তঃপুর ছেড়ে চলে আসতে হলো বারবাড়িতে। এখন মানুষ হতে লাগলেন চাকরবাকরদের তত্ত্বাবধানে। কী কঠোর সে জীবনযাত্রা! বড়োলোকি বিলাসিতার ধারে-কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হতো না তাঁকে। একান্ত গরিবি হালে বাল্যকাল কেটেছে। গায়ে খুব অল্প কাপড় থাকত সুতির একটি জামা, আর একটি পায়জামা। প্রচন্ড শীতে হয়তো আরেকটি সুতির জামা যোগ হয়েছে, তবে বেশি আর কিছু নয়। বুড়ো নেয়ামত দরজি, চোখে গোল গোল চশমা, জামা গড়িয়ে দিত, কিন্তু সে জামায় পকেট থাকত না কখনো। দশ বছর বয়সের আগে মোজা পরতে পাননি তিনি। উঠতে হতো ভোরে। বেশি শীত লাগলে পায়ে পায়ে এগুতেন তোশাখানার দিকে চাকরেরা যেখানে থাকে সেদিকে। উদ্দেশ্য, যদি একটু আগুন মেলে, সেঁকে নেওয়া যায় হাত-পাগুলো। আধো অন্ধকারে হয়তো তখন জ্যোতিদার জন্যে চিন্তে রুটি টোস্ট করছে। বড়ো ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের খাস চাকর চিন্তা, 'চিন্তে' বলেই ডাকে সকলে। লোহার আংটায় কাঠের কয়লা জ্বালিয়ে তার ওপরে ঝাঁঝরি রেখে রুটি টোস্ট করছে সে। আর গান গাইছে গুনগুন, মধুকানের গান। পাউরুটির ওপর মাখন গলার গন্ধে সারা ঘর ভরা। জিভে জল এসে গেল, লোভাতুর দৃষ্টিতে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। কিন্তু হায়! চিন্তের কী কঠোর প্রাণ। টোস্ট-করা রুটি নিয়ে চলে গেল যথানিয়মে। তাঁর বরাতে কিছুই জুটল না। রুটিন মাফিক যে খাবার বরাদ্দ ছিল তাই খেতে হয়েছে মুখ গুঁজে। আবদার করার কেউ নেই, কান্নাকাটি করলেও হৃদয় গলবে না কারো।

 

বুদ্ধ জীবনের ফাঁকে বৈচিত্র্যও আসত কখনো সখনো। হয়তো শখের যাত্রা হবে বাড়িতে। যাত্রার পাটি গেছে। 'বারান্দা জুড়ে বসে গেছে দলবল, চারিদিকে উঠছে তামাকের ধোঁয়া। ছেলেগুলো লম্বা-চুল-ওয়ালা, চোখে- কালি-পড়া: অল্প বয়সে তাদের মুখ গিয়েছে পেকে, পান খেয়ে খেয়ে ঠোঁট গিয়েছে কালো হয়ে। সাজগোজের আসবাব আছে রং-করা টিনের বাক্সোয়।' তবু শেষ রক্ষা হতো না। যাত্রা দেখার পূর্বেই ঘুমোতে যেতে হতো, জোর করে ধরে নিয়ে যেত কোনো চাকর।

 

দিন চলেছিল এভাবে, মন্থর গতিতে। পালোয়ান জমাদার সোভারাম থেকে থেকে মুগুর ভাঁজত মস্ত ওজনের, বালক রবি ও আরো দু-এক জন তার কানের কাছে গিয়ে চিৎকার করে উঠত 'রাধাকৃষ্ণ'। মাইনে-করা দিনু স্যাকরা ফোঁস ফোঁস করে হাপর টানছে, উঠোনে বসে তুলো ধুনছে ধুনুরি। কানা পালোয়ান হিরা সিংয়ের সঙ্গে কুস্তি লড়ছে মুকুন্দলাল দারোয়ান, চটাচট লাগাচ্ছে চাপড় দুই পায়ে, ডন ফেলছে বিশ-পঁচিশ বার ঘন ঘন। ভিখারির দল বসে আছে ভিখ নেবে বলে। গল্প বলছে আবদুল মাঝি দাড়ি নেড়ে নেড়ে: 'আমি ডাক দিলুম, "আও বাচ্চা।" সে সামনের দু পা তুলে উঠতেই দিলুম তার গলায় ফাঁস আঁটকিয়ে... ডিঙির সঙ্গে জুড়ে বাঘের বাচ্চাকে দিয়ে গুন টানিয়ে নিলেম অন্তত বিশ ক্রোশ রাস্তা। গোঁ গোঁ করতে থাকে, পেটে দিই দাঁড়ের খোঁচা, দশ- পনেরো ঘণ্টার রাস্তা দেড় ঘন্টায় পৌঁছিয়ে দিলে।'

 

এমনিভাবে দিন কাটে। হাতেখড়ি সবেমাত্র হয়েছে। ছড়ার রাজ্য আর পরির দেশের বন্ধ দুয়ার তাঁর চোখের সামনে খুলে গেল। শ্রীকণ্ঠ বাবু ছিলেন বাড়ির বন্ধু, দিনরাত গানের মধ্যে ডুবে থাকতেন। বারান্দায় বসে তিনি চামেলির তেল মেখে স্নান করতেন, হাতের গুড়গুড়ি থেকে ভুর ভুর করে অম্বুরি তামাকের সুগন্ধ উঠত, গুনগুন করে গান করতেন। যখন আর আনন্দ ধরে রাখতে পারতেন না, তখন উঠে দাঁড়াতেন, নেচে নেচে বাজাতে থাকতেন সেতার, হাস্যোজ্জ্বল চোখ বড়ো বড়ো করে গান ধরতেন- 'ময় ছোড়োঁ ব্রজকী বাসরী'। সত্যপ্রসাদের বোন ইরু ইরাবতী, সে আবার কোনখানে 'রাজার বাড়ি' আবিষ্কার করেছিল! কেবলই গল্প করত রাজবাড়ির। সে স্যাঁতসেঁতে এঁদো কুঠরিতে বিরাট জালাগুলোয় ভরা থাকত সংবৎসরের খাবার জল, সেই ঘরে আরো যেন কাদের বাস ছিল-তাদের মস্ত হাঁ, চোখ দুটো বুকে, দুটো কান ঠিক যেন কুলো আর পা দুটো উলটো দিকে। বাড়ির পশ্চিম কোণে ঘন পাতাওয়ালা বাদাম গাছ। তারই এক ডালে এক পা, আরেক পা তেতলার কার্নিসের ওপর দিয়ে আঁধার রাতে দাঁড়িয়ে থাকত বিরাট এক ব্রহ্মদত্যি। একটা পালকি ছিল ঠাকুরমাদের আমলের। সেটা দেখতে নবাবি ছাঁদের, খুব দরাজ বহর ছিল তার। সেই পালকিই আস্তানা হতো এই বালকের। মনে হতো, পালকিটা যেন সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপ, আর সে ছুটির দিনের রবিনসন ক্রুসো। বেলা বেড়ে যায়, রোদ্দুর ওঠে কড়া হয়ে, দেউড়িতে ঘণ্টা বাজে; কিন্তু পালকির ভিতরের দিনটা কোনো ঘণ্টার হিসেব মানে না। তার মধ্যে বসে বসেই সময় বয়ে যায়, হাজার রকমের খেয়ালখুশি ভিড় করে মগজে। বড়ো হলে তিনি নিজেই একটা চিঠিতে লিখেছিলেন এ রকম:

 

মনে আছে এক একদিন সকাল বেলায় অকারণে অকস্মাৎ খুব একটা জীবনানন্দ মনে জেগে উঠত। তখন পৃথিবীর চারিদিক রহস্যে আচ্ছন্ন ছিল।.... গোলাবাড়িতে একটা বাঁখারি দিয়ে রোজ রোজ মাটি খুঁড়তুম, মনে করতেম কি একটা রহস্য আবিষ্কার হবে। দক্ষিণের বারান্দার কোণে খানিকটা ধুলো জড়ো করে তার ভিতর কতকগুলো আতার বিচি পুঁতে রোজ যখন-তখন জল দিতেম ভাবতেম এই বিচি অঙ্কুরিত হয়ে উঠলে সে কি একটা আশ্চর্য ব্যাপার হবে। পৃথিবীর সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ, সমস্ত নড়াচড়া আন্দোলন- বাড়ির ভিতরের বাগানের নারিকেল গাছ, পুকুরের ধারের বট, জলের উপরকার ছায়ালোক, রাস্তার শব্দ, চিলের ডাক, ভোরের বেলাকার বাগানের গন্ধ, ঝড়-বাদলা সমস্ত জড়িয়ে একটা বৃহৎ অর্ধপরিচিত প্রাণী নানা মূর্তিতে আমায় সঙ্গ দান করত।

 

সব শিশুরই ছেলেবেলা হয়তো এভাবেই কেটে যায়। তোমরাও তো এ রকমই করতে রাজ্যের ধূলোমাটি-মাখা আর অসম্ভবের স্বপ্নে প্রহর কাটানো; তাই না?

 

কিন্তু এমনি করে দিন কেটে গেলে তো চলবে না। গুরুজনদের তত্ত্বাবধানে নিয়মমাফিক নানা প্রকার শিক্ষাভ্যাস শুরু হলো। খুব ভোরে তাঁকে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হতো, তা সে শীতকালই হোক, কি বর্ষা কিংবা গ্রীষ্ম হোক না কেন। হ্যাঁ, তারপর সেই অত ভোরে উঠেই এক কানা পালোয়ান হিরা সিংয়ের কাছে ল্যাঙ্গোট পরে ধুলোমাটি মেখে কুস্তি লড়তে হতো। কুস্তি লড়া শেষ হতে না হতে মাইনে-করা মাস্টার মশাই চলে আসতেন ভূগোল- ইতিহাস ইত্যাদি পড়াবার জন্যে। তারপর তো স্কুল। বিকেলবেলা স্কুল থেকে মেজাজ খিচড়ে ফিরে এলেন। তবু কি নিস্তার আছে? ড্রয়িং মাস্টারের কাছে ছবি-আঁকা শিখতে বসলেন; আরেকটু পরে আবার কিঞ্চিৎ ব্যায়াম। বিকেলবেলা কিনা, তাই। সন্ধের পর ইংরেজি পড়া, প্যারী সরকারের ফার্স্ট বুক। কিন্তু যেই বই হাতে-নেওয়া অমনি কোথেকে রাজ্যের ঘুম চলে আসত, আর বইয়ের ওপর মুখ গুঁজে ঢুলতে আরম্ভ করতেন। ভাগ্যিস বড়দা প্রায়ই বারান্দা দিয়ে যেতেন ঐ সময়ে। ঢুলতে দেখে তিনি ছুটি দিয়ে দিতেন। আর যেই না ছুটি পাওয়া, অমনি সোজা অন্তঃপুরের মধ্যে মার কাছে দৌঁড়। তখন কোথায় ঘুম, আর কোথায়ই বা ঢুলুনি!

 

ছোটোবেলায় অসুখবিসুখ বড়ো একটা করত না। অসুখ তৈরি করে পড়া ফাঁকি দেওয়ার কত চেষ্টাই না করেছেন: জুতো ভিজিয়ে পায়ে দিয়ে বেড়ালেন সারা দিন, কোথায় সর্দি? কিছু হলো না। কার্তিক মাসে খোলা ছাদে শুয়ে আছেন, সকালে যখন উঠলেন তখন শিশিরে চুল-জামা সব ভিজে গেছে। কিন্তু হায় রে। গলার মধ্যে একটু খুশখুশ করে কাশিও হলো না। বদহজমের ফলে পেটও কামড়ায়নি কোনোদিন। যদি কামড়াত কখনো তো সে নিতান্তই দায়ে পড়ে। মা যদিও বুঝতেন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে যে কোন ধরনের বদহজম হয়েছে ছেলের, তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, 'মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়াতে হবে না।' কী আনন্দ!

এ তো গেল রোজকার রুটিন। এ ছাড়া আরো বাড়তি আছে অনেক কিছু। রোববার সকালে এক মাস্টার মশাই আসেন বিজ্ঞান শেখাতে। এই জিনিসটা বেশ ভালো লাগত বালক রবীন্দ্রনাথের। বিজ্ঞান পড়তে গেলে কত রকম কলকবজা, জিনিসপত্তর নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়। ঐ সব খুঁটিনাটি জিনিসপত্র নিয়ে সময় কাটাতে তাঁর খু-উ-ব ভালো লাগত। এ সময়েই আবার মেডিকেল স্কুলের এক ছাত্র আসত অস্থিবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান দান করতে। তার জন্যে একটা নরকঙ্কাল কিনে এনে পড়বার ঘরে টাঙিয়ে রাখা হলো। বাংলা ভাষা শিক্ষাও পুরোদমে চলেছে। সুর করে করে কৃত্তিবাসের 'রামায়ণ' তো কবেই পড়া হয়ে গেছে। এখন মাইকেলের 'মেঘনাদবধ কাব্য' পড়া শুরু হলো; এ বয়েসেই তিনি এ রকম শক্ত একটা বই পড়া শেষ করেন। তোমরা শুনে নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে, এই বই এখন এসএসসি পাস করা ছেলেও পড়তে পারে না, অথবা পড়লেও বোঝে না; তিনি কিন্তু এগারো বছর পার না-হতেই এ বই পড়েছিলেন।

 

 

শব্দের অর্থ

 

ধুনুরি: যারা তুলা দিয়ে লেপ-তোশক তৈরি করে। 

ধোনা: বিশেষ যন্ত্র দিয়ে তুলাকে আলগা করা। 

নবাবি ছাঁদ: নবাবি ধরন। 

পত্তন: শুরু। 

পাথরের চাঙ্গড়: পাথরের খণ্ড। 

প্রশ্রয়: আশকারা। 

ফরাস: ঝাড়ামোছার কাজ করে যে। 

ফিকে: অনুজ্জ্বল। 

ফিরিঙ্গি: ইউরোপীয় জাতি। 

বয়োজ্যেষ্ঠ: বয়সে বড়ো। 

বর্শা: একপ্রান্তে লোহার ফলাযুক্ত হাতিয়ার। 

বাখারি: বাঁশের মোটা চটা। 

বৈঠকখানা: বাড়ির বাইরের দিকে বসার ঘর। 

মুগুর: মাথা মোটা এক ধরনের হাতিয়ার। 

মুসাফির: অতিথি। 

রুদ্ধ: বন্ধ। 

শেষাবধি: শেষ পর্যন্ত। 

সহিস: ঘোড়ার দেখাশোনা করে যে। 

সেকেলে: পুরানো। 

স্থানান্তর: অন্য স্থান। 

স্বল্লালোক: অল্প আলো। 

হাঁই-হুই: হাঁকডাক।

Content added || updated By
Promotion